প্রকাশিত: Sat, Jan 13, 2024 12:52 AM
আপডেট: Wed, Jun 18, 2025 3:13 PM

[১]নির্বাচনে হেরে ‘বিব্রত ও প্রতারিত’ বোধ করছেন আওয়ামী লীগের মিত্ররা

ইকবাল খান: [২] ক্ষমতাসীন দলটির জোটসঙ্গী ও মিত্র দলের নেতারা অভিযোগ করছেন, সংসদ নির্বাচনের আগে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ দিয়েছিল, তারা সে কথা রাখেনি। নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের অনেকেই এখন ‘বিব্রত’ এবং ‘প্রতারিত’ বোধ করছেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।

[৩] বিএনপিবিহীন এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে আরও ২৬টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। এসব দলের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের ১৫ বছরের জোটসঙ্গী জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টি যেমন ছিল, তেমনি ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জাতীয় পার্টিও।

[৪] ‘কিংসপার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি-সহ বেশ কয়েকটি ছোট দলকেও এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে দেখা গেছে।

[৫] নির্বাচনের আগে এসব দলের নেতারা ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে’ ভোট হবে বলে প্রচারণা চালালেও ভোটের ফলাফল দেখার পর এখন তারা উল্টো সুরে কথা বলছেন।

[৬] “জনগণের ভোটে নয়, কারচুপির ভোটে আমাকে পরাজিত করা হয়েছে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু।

[৭] অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের মিত্র জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্ট, এমন কি ‘কিংসপার্টি’ গুলোর পক্ষ থেকেও।

[৮] তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘হেরে গেলে অনেকেই অনেক কথা বলার চেষ্টা করেন’।

[৯] রাজশাহী-২ আসনে টানা গত ১৫ বছর সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি এবারও আসনটিতে জোটের প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেরেছেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিকুর রহমানের কাছে। যদিও নির্বাচনের এই ফলাফল তিনি মেনে নেননি। [১০] বিবিসি বাংলাকে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেছেন, ‘ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে অরাজকতা ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে তারা এই নির্বাচন করেছে।’ নির্বাচনে কী কী ধরনের অনিয়ম করা হয়েছে, তার একটি ফর্দ তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছেন তিনি।

[১১] তাহলে কি আওয়ামী লীগ তার কথা রাখতে পারেনি? এই প্রশ্নের জবাবে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কথা রাখতে পারেনি বলাটাও খুব দুর্বল দেখায়। আওয়ামী লীগ কথা রাখেনি।”

[১২] ‘আমি বিব্রত হয়েছি’: ফজলে হোসেন বাদশার মতো একই ঘটনা ঘটেছে ১৪-দলীয় জোটের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে। কুষ্টিয়া-২  আসনে এবার নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেও তিনি স্বতন্ত্রপ্রার্থী কামারুল আরেফিনের কাছে পরাজিত হয়েছেন ২৩ হাজারেরও বেশি ভোটে।

[১৩]  কামারুল আরেফিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতা, যাকে নিজ এলাকার বাইরে সেভাবে কেউ চেনেন না। অন্যদিকে, ইনু জাতীয় পর্যায়ের একজন সুপরিচিত প্রার্থী। 

[১৪] আর এতে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। “আমি বিব্রত হয়েছি। একটু বিব্রত হয়েছি”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

[১৫] “জনগণ আমার পক্ষে ছিল, কিন্তু এখানে ১৮টি কেন্দ্রে ভোট কারচুপির মাধ্যমে আমাকে পরাজিত করা হয়েছে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন ইনু। তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগ আমাকে দলগতভাবে সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু তাদের ভেতরের একটি বড় অংশ আমার বিপক্ষে কাজ করেছে। তারাই এসব ঘটিয়েছে।” 

[১৬] ক্ষুব্ধ ও বিব্রত হাসানুল হক ইনু এখন বিষয়টি জোটের সভায় তোলার অপেক্ষায় আছেন। “বিষয়টি নিয়ে আমরা বাকীদের সাথে আলোচনা করবো। জোটনেত্রী তখন কী নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সেটি দেখে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবো” বিবিসি বাংলাকে বলেন ইনু।

[১৭] জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে জিতেছে এবং সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয়েছে।

[১৮] কিন্তু নির্বাচন শেষে দেখা যাচ্ছে, দলটি এককভাবে জয় পেয়েছে মাত্র ১১টি আসনে। নির্বাচনে নিজেদের এই পরিণতির জন্য এখন ক্ষমতাসীনদেরই দুষছেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

[১৯] “উনারা (আওয়ামী লীগ) বলেছিলেন যে, সবখানে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন জি এম কাদের।

[২০] নির্বাচনে ‘ব্যাপক ভোটকারচুপি’র অভিযোগ তুলে দলটির চেয়ারম্যান বলছেন, ভোট ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হলে তারা আরও বেশি আসন পেতেন।

[২১] “আমরা বলছি না যে সবখানে বিজয়ী হতাম, কিন্তু আরও অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশটি আসনে ভালোরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো”, বিবিসি বাংলাকে বলেন জি এম কাদের। “কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেলো যেখানে আমাদের এবং নৌকার প্রার্থী ছিল, সেখানে লাঞ্চের পর থেকে ঢালাওভাবে সব ভোটকেন্দ্র দখল করে তারা ভোট দিয়েছে” বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।

[২২] এছাড়া নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে ২৬টি আসনে ছাড় দেওয়া হয়েছিল, সেখানেও এখন “ষড়যন্ত্রের” গন্ধ পাচ্ছে জাতীয় পার্টি। “আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আলাপ-আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু তারা নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে আসন ভাগাভাগির কথা জানালো। এটা ইচ্ছাকৃত, নাকি ভুল জানি না। তবে নানাভাবে আমরা একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গেছি।” বিবিসি বাংলাকে বলেন জিএম কাদের।

[২৩] ‘প্রতারিত’ বোধ করছে কিংসপার্টি গুলো: এবারের নির্বাচনে ‘কিংসপার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি শুরু থেকেই বেশ আলোচনায় ছিল।

[২৪] ক্ষমতাসীনদের সুরের সাথে সুর মিলিয়ে তারাও ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হবে’ বলে প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, দলগুলোর অধিকাংশ প্রার্থীই জামানত হারিয়েছেন। ফলে এখন তাদের সুরও পাল্টাতে শুরু করেছে। নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে এবার ভোটে দাঁড়িয়ে জামানত হারিয়েছেন তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার।

[২৫] তার আসনে প্রায় পৌনে চার লাখ ভোটারের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভোটার ভোট দিয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এর মধে তৈমুর  খন্দকার পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৯০ ভোট। তিনিও এখন ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলছেন।

[২৬] “যত ভোট পড়েছে বলে দেখানো হচ্ছে, সেটা হাস্যকর। বাস্তবে এতো পড়েনি। এটা কোন নির্বাচনই হয়নি” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তৈমুর খন্দকার।

[২৭] একই কথা বলছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর। তিনি ফরিদপুর-১ আসন থেকে নির্বাচনে করে জামানত হারিয়েছেন। আসনটিতে গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হলেও সেটি মানতে নারাজ শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর।

[২৮] “মাঠে আমরা যে চিত্র দেখেছি, তাতে ১২ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার কথা না। ম্যাকানিজম করে ভোট বাড়ানো হয়েছে।”, বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।

[২৯] এই অভিজ্ঞতায় আওয়ামী লীগের ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের’ প্রতিশ্রুতির কথা মনে হলে ‘প্রতারিত’ বোধ করছেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন কিংসপার্টির একজন তৈমুর আলম খন্দকার। “সরকার আমাদের বলছিল যে, একটা সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন হবে। কিন্তু সেটি হয়নি। কাজেই প্রতারিত মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক” বিবিসি বাংলাকে বলেন তৈমুর খন্দকার।

[৩০] আওয়ামী লীগ কী বলছে?  বিবিসি বাংলাকে বলেন দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, ‘জনগণ ভোট না দিলে সে দায় আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপানোর কোন সুযোগ নেই”  “নিবাচন যে সুষ্ঠু-সুন্দর হয়েছে, সেটা সবাই দেখেছে। বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও বলেছে। কাজেই এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে শোভনীয় নয়। এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা উচিত” বিবিসি বাংলাকে বলেন বাহাউদ্দিন নাছিম।